টেক দুনিয়ায় সুন্দর পিচায়ের নাম শুনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট গুগলের সিইও হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে দায়িত্বপালন করা অসম্ভব মেধাবী এই ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ ২০০৪ সালে এক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে গুগলে চাকরি পেয়েছিলেন। সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেদিনের সেই ইন্টারভিউর গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ।

যখন আমরা কোনো চাকরির সাক্ষাতকার দিতে যাই, তখন আমরা এমন কিছু বলতে চাই যেন অন্য সব চাকরিপ্রার্থীর চেয়ে আমাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এর অর্থ হচ্ছে, কীভাবে প্রতিটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেয়া যায় এবং আপনাকে আটকানোর জন্য করা ট্রিকি কোয়েশ্চনের (চাকরিপ্রার্থীর মেধা যাচাইয়ে করা বুদ্ধিভিত্তিক প্রশ্ন) জবাব দেয়া যায়। কিন্তু আপনি যদি প্রশ্নের উত্তরই না জানেন তাহলে? ঠিক এমনই একটি সমস্যা পড়েছিলেন মার্কিন টেক জায়ান্ট গুগলের বর্তমান সিইও সুন্দর পিচাই, ভাইস প্রেসিডেন্ট অফ প্রডাক্ট ম্যানেজমেন্ট পদের জন্য ২০০৪ সালে যখন প্রথবারের মতো তিনি গুগলে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন।

২০১৭ সালে নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে এসে সেখানকার ছাত্রদের সাথে এক আড্ডায় এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি টেক কোম্পানির ইন্টারভিউ অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি শেয়ার করেছেন গুগল সিইও।
ইন্টারভিউর প্রথম রাউন্ড

সাক্ষাতকারের প্রথম রাউন্ডে সুন্দর পিচাইকে প্রশ্নকারী জিজ্ঞেস করেন, জিমেইল সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? একটা সমস্যা ছিলো যে, ওইদিনই মাত্র ইমেইল সার্ভিসটি চালুর ঘোষণা দিয়েছিলো গুগল। দিনটি ছিলো এপ্রিলের প্রথম দিন। পিচাই বলেন, আমি ভেবেছিলাম এটি মনে হয় এপ্রিল ফুলের একটি কৌতুক! সুন্দর পিচাই প্রশ্নকারীদের জবাব দেন, তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না কেননা তিনি এই ফিচারটি এখনও ব্যবহার করেননি।

প্রশ্নকারী তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি জিমেইল দেখেছেন? তিনি জবাব দেন, না। এরপর তাকে জিমেইলের বিস্তারিত দেখানো হলে পঞ্চম প্রশ্নকারী তাকে জিজ্ঞেস করেন জিমেইল সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? পিচাই বলেন, এরপর আমি এর জবাব দিতে সক্ষম হই এবং বলতে শুরু করি। এই অবস্থায় অধিকাংশ প্রার্থীই কিছু একটা বলে পরের প্রশ্নে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। তবে সুন্দর পিচাই করেছে ঠিক উল্টোটা এবং এতে ইন্টারভিউয়াররাই প্রভাবিত হয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি চাকরিটা পেয়েছিলেন। কারণ তার উত্তরটি ছিলো অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত।
১. তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক সততা দেখিয়েছিলেন

চাকরির ভাইভাতে নিয়োগকর্তাকে সরাসরি কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানার কথা বললে কিছু পয়েন্ট হয়তো কমে যাবে। তবে কোনো প্রশ্নের ভুল উত্তর দেয়ার চেয়ে এটা অনেক ভালো। বিজ্ঞানও এই বিষয়ে একমত যে, যে মানুষগুলো বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সৎ অর্থাৎ যারা নিজের না জানাকে স্বীকার করতে পারে তারা অনেক ভালো শিক্ষার্থী হয়ে থাকে। গুগলের পিপলস অপারেশন্সের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট লাসলো বক যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইন্টারভিউতে বুদ্ধিবৃত্তিক সততার এই গুণটিকেই তিনি একজন চাকরিপ্রার্থীর মাঝে সবার আগে খুঁজে থাকেন। সফল মেধাবী ব্যক্তিরা খুব কমই ব্যর্থ হয়, আর তাই ব্যর্থতা থেকে শেখার বিষয়টি তারা জানেন না।

এর পরিবর্তে তারা একটি মৌলিক ভুল করে থাকেন। তা হচ্ছে- যদি কোনো ভালো কিছু হয় তাহলে তারা বলেন, আমি একজন জিনিয়াস (অত্যন্ত মেধাবী) ব্যক্তি। আর যদি খারাপ কিছু ঘটে তাহলে তারা বলেন, এটা ঘটেছে অমুকদের বোকামির কারণে অথবা তারা বলে আমার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য ছিলো না বা বাজারের উত্থান-পতন হয়েছে। সুতরাং, এরপর থেকে যখন আপনি কোনো কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন, উত্তর দেয়ার আগে ঠান্ডা মাথায় কিছুটা সময় নিয়ে চিন্তা করবেন।

সুন্দর পিচাই প্রশ্নটি নিয়ে সুন্দর উপায়ে ভেবেছেন। তিনি কী বলবেন যে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না? ওই সময়ে জিমেইল মাত্র কেবলই বাজারে এসেছে। সুতরাং তিনি বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, এই বিষয়ে তার না জানাটাই স্বাভাবিক।
২. তিনি একটি কারণ দেখিয়েছিলেন

‘আমি জানি না’ স্বাভাবিকভাবে এটা বলে না দিয়ে তিনি প্রশ্নকর্তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কেন তিনি জানেন না। পিচাই তার ইন্টারভিউয়ারকে বলেন, তিনি এই ফিচারটি ব্যবহার করেননি, তাই তিনি সে সম্পর্কে জানেন না। এর মাধ্যমে তিনি তার আগ্রহ দেখিয়েছেন যা একজন নিয়োগকর্তা সবসময় চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে দেখতে ভালোবাসেন।

এই অবস্থায় পিচাই তার সম্ভাবনাটা দেখতে পেয়েছিলেন যে, প্রতিটি ‘আমি জানি না’-এর মধ্যেই আছে জানার একটি সুযোগ। আর তাই চতুর্থ রাউন্ডেই প্রশ্নকর্তারা তাকে জিমেইল ফিচারটি দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
৩. তিনি কথাপোকথনটি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন

বিষয়টি তিনি জানেন না বলার পর সুন্দর পিচাই কথাপোকথনটি সেদিকে নিয়ে গেছেন যা তিনি জানেন। জিমেইল ফিচারটি এক নজর দেখে পণ্যটি সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার ধারণা পেয়ে যান। এটিই তাকে তার মেধা ও প্রতিভা দেখাতে সাহায্য করে যে, দ্রুতই তিনি গুগলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হতে চলেছেন। এরপর মাত্র ১১ বছরের ব্যবধানে তিনি গুগলের সর্বোচ্চ পদে নিয়োগ পান। বুদ্ধিবৃত্তিক সততার সুবিধা হচ্ছে এর মাধ্যমে আপনি যা জানেন সে সম্পর্কে বলার সুযোগ পাবেন। উদাহরণ হিসেবে সুন্দর পিচাইয়ের ঘটনাটাই সর্বোত্তম।

তিনি যথাযথ প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন এবং বিনয়ের সাথে একটি কঠিন পরিস্থিতিকে সামাল দিয়েছেন। প্রবাদের সেই মহিষের শিং তিনি ধরে ফেলেছিলেন এবং চ্যালেঞ্জের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। ফলে মোটা অঙ্কের বেতনও পেয়েছেন। প্রতি মাসে তার আয় প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার। বছরে তার আয় কয়েক কয়েক’শ কোটি টাকা।

এছাড়া বোনাস ও গুগলের স্টক শেয়ার থেকেও পান মোটা অঙ্কের অর্থ। তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
খুঁজে বের করুন নিজের ভেতরের সুন্দর পিচাইকে

প্রতি বছর লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী গুগলে আবেদন করেন। আপনার গুগলে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে মাত্র দশমিক ২ শতাংশ (০.২)। যদি একের পর পরীক্ষায় সফল হয়ে আপনি সরাসরি ভাইভাতে যাওয়ার সুযোগ পান তাহলে চিন্তা করবেন কীভাবে আপনি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেন। ওই দশমিক ২ শতাংশের (০.২) একজন হিসেবে নিজের স্থানটি নিশ্চিত করার উপায় খুঁজতে থাকুন।

 

কলমকথা/সাথী